যাকাত ও ফিতরা আদায় ২০২৫ সালের: অর্থ হিসাব ও পরিমাণ সম্পূর্ণ গাইড

যাকাত ও ফিতরা ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক ইবাদত, যা ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সম্পদের ভারসাম্য রক্ষা করে। ইসলাম আমাদের সম্পদের মধ্যে দরিদ্রদের অধিকার নির্ধারণ করে দিয়েছে, এবং এটি আদায় করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

যাকাত হলো নিসাব পরিমাণ সম্পদের ওপর নির্ধারিত হার অনুযায়ী নির্দিষ্ট অংশ গরিব ও দুঃস্থদের প্রদান করা। অন্যদিকে, ফিতরা হলো ঈদুল ফিতরের আগে প্রতিটি সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য নির্ধারিত দান, যা গরিবদের ঈদের আনন্দে শামিল করার জন্য ফরজ করা হয়েছে।

কুরআন ও হাদিসে যাকাত ও ফিতরার গুরুত্ব:
কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“আর তোমরা সালাত কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।” (সুরা বাকারা: ৪৩)

হাদিসে নবী (সাঃ) বলেন:
“ইসলামের ভিত্তি পাঁচটি বিষয়ের উপর প্রতিষ্ঠিত; (১) এই সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর রাসূল; (২) সালাত কায়েম করা; (৩) যাকাত প্রদান করা; (৪) রমজানের রোজা রাখা; (৫) হজ করা।” (বুখারি ও মুসলিম)

যাকাত সম্পর্কে

যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত

যাকাত ফরজ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়:
মুসলমান হওয়া – অমুসলিমদের জন্য যাকাত ফরজ নয়।
বালেগ হওয়া – প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য যাকাত ফরজ।
আকılবান হওয়া – মানসিক ভারসাম্যহীন ব্যক্তির জন্য যাকাত ফরজ নয়।
নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া – যদি কারো ন্যূনতম সম্পদ নিসাব পরিমাণের সমান বা বেশি হয়, তবে তার ওপর যাকাত ফরজ হবে।
ঋণমুক্ত সম্পদ থাকা – যদি কেউ নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হয় কিন্তু অনেক ঋণগ্রস্ত হয়, তাহলে যাকাত ফরজ নয়।
এক বছর অতিবাহিত হওয়া – অর্থ বা সম্পদ এক বছর ধরে থাকলে তবেই যাকাত দিতে হবে।

যাকাতের হার ও হিসাব করার পদ্ধতি

ইসলামে যাকাতের হার নির্ধারণ করা হয়েছে ২.৫%। অর্থাৎ, যদি কারো যাকাতযোগ্য সম্পদের পরিমাণ ১০ লাখ টাকা হয়, তাহলে তাকে ১০,০০,০০০ × ২.৫% = ২৫,০০০ টাকা যাকাত দিতে হবে।

নিসাব পরিমাণ সম্পদ

সোনা: ৮৫ গ্রাম (সোনার বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী হিসাব করতে হবে)
রূপা: ৫৯৫ গ্রাম
নগদ টাকা: ব্যাংক বা হাতে থাকা অর্থ
ব্যবসার পণ্য ও মুনাফা
শেয়ার ও বিনিয়োগ
কৃষিজাত পণ্য ও পশুপালন থেকে আয়

২০২৫ সালের যাকাতের হার ও হিসাব

২০২৫ সালের জন্য জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া কর্তৃক নির্ধারিত যাকাতের হার:

সম্পদপ্রতি ভরির মূল্যমোট নিসাব পরিমাণযাকাতের হার (২.৫%)
সোনা (২২ ক্যারেট)১,৩৮,৩৪৮ টাকা১০,৩৭,৬১০ টাকা (৭.৫ ভরি)২৫,৯৪০ টাকা
রূপা৯,৯৮৭ টাকা৫,২৪,৩১৭ টাকা (৫২.৫ ভরি)১৩,১০৮ টাকা
নগদ অর্থ৫,২৪,৩১৭ টাকা১৩,১০৮ টাকা

ফিতরা সম্পর্কে

ফিতরা ফরজ হওয়ার শর্ত

✅ যাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচের বাইরে অতিরিক্ত সম্পদ আছে, তাদের জন্য ফিতরা ফরজ।
✅ ঈদের আগেই ফিতরা আদায় করা উত্তম।

২০২৫ সালের ফিতরার হার

জামিয়া রহমানিয়া আরাবিয়া কর্তৃক নির্ধারিত ২০২৫ সালের ফিতরার হার:

খাদ্যদ্রব্যপরিমাণপ্রতি কেজির দরমোট ফিতরা
গম৩.২৫ কেজি৮০ টাকা২৬০ টাকা
খেজুর৩.২৫ কেজি৩৫০ টাকা১,১৩৭ টাকা
কিসমিস৩.২৫ কেজি৯০০ টাকা২,৯২৫ টাকা
যব৩.২৫ কেজি৮০ টাকা২৬০ টাকা
গম/আটা১.৬৩ কেজি৬০ টাকা১০০ টাকা

সর্বনিম্ন ফিতরা: ১০০ টাকা
সর্বোচ্চ ফিতরা: ২,৯২৫ টাকা

যাকাত ও ফিতরার সামাজিক ও আধুনিক দিক

অনলাইনে যাকাত ও ফিতরা প্রদান – এখন অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ফিন্যান্সিং (বিকাশ, নগদ) এবং ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যাকাত ও ফিতরা দেওয়া সহজ।
দারিদ্র্য বিমোচন – দরিদ্র ও অসহায়দের সাহায্য করতে যাকাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সমাজের ভারসাম্য রক্ষা – ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে পার্থক্য কমানো যায়।

যাকাত ও ফিতরা আদায় ২০২৫ সালের: অর্থ হিসাব ও পরিমাণ সম্পূর্ণ গাইড

যাকাত কী?

ইসলামে যাকাত একটি বাধ্যতামূলক ইবাদত, যা আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য নির্ধারিত। এটি সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরীব ও দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করার মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখে।

যাকাতের মূল অর্থ হলো পবিত্রতা ও বৃদ্ধি। এটি সম্পদের শুদ্ধি ঘটায় এবং ধনসম্পদের মধ্যে বরকত আনে। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ, যা কুরআন ও হাদিসে বারবার গুরুত্বের সঙ্গে বর্ণিত হয়েছে।

যাকাত দিতে হবে? এটি কি বাধ্যতামূলক?

হ্যাঁ, যাকাত দেওয়া প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক (ফরজ)। এটি ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম এবং কুরআন ও হাদিসে যাকাত আদায়ের ব্যাপারে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

যারা নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের (নিসাব পরিমাণ) মালিক এবং এক বছর পর্যন্ত সেই সম্পদ তাদের কাছে থাকে, তাদের উপর ২.৫% হারে যাকাত দেওয়া ফরজ। যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে যাকাত না দেয়, তবে এটি গুনাহের কাজ এবং কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হবে।

কুরআনের দলিল:

“আর তোমরা সালাত কায়েম কর এবং যাকাত প্রদান কর। আর রুকুকারীদের সাথে রুকু কর।”
(সূরা আল-বাকারা: ৪৩)

হাদিসের দলিল:

“যে ব্যক্তি তার সম্পদের যাকাত দেয় না, কিয়ামতের দিন সেই সম্পদ বিষধর সাপের রূপ ধারণ করবে এবং সে সাপ মালিকের গলায় পেঁচিয়ে তাকে দংশন করবে।”
(বুখারি, হাদিস: ১৪০৩)

তাই, যাকাত দেওয়া শুধু দান-সদকার বিষয় নয়; বরং এটি প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের উপর ফরজ এবং ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিধান।

যাকাত দিলে কী হয়?

যাকাত দেওয়া ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং এটি ব্যক্তিগত, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক জীবনে অসংখ্য কল্যাণ বয়ে আনে। কুরআন ও হাদিসে যাকাত দেওয়ার অসংখ্য ফজিলত ও উপকারিতা উল্লেখ করা হয়েছে।

১. আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের প্রতিশ্রুতি

  • যাকাত আদায় করলে আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট হন এবং জান্নাতের প্রতিশ্রুতি দেন।
  • কুরআনে বলা হয়েছে: “তারা নামাজ কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে, তাদের প্রতিদান তাদের রবের কাছে রয়েছে, তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।” (সূরা বাকারা: ২৭৭)
  • রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি নিজের হালাল উপার্জন থেকে যাকাত দেয়, সে জান্নাতে যাবে।” (সহিহ বোখারি: ১৪০৩)

২. সম্পদের বরকত বৃদ্ধি পায়

  • যাকাত সম্পদকে পরিশুদ্ধ করে এবং এতে বরকত হয়।
  • আল্লাহ বলেন: “তোমরা যদি দান করো, তবে আল্লাহ তোমাদের সম্পদ বাড়িয়ে দেবেন।” (সূরা সাবা: ৩৯)
  • রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যাকাত সম্পদের ক্ষতি করে না বরং সম্পদ বাড়িয়ে দেয়।” (সহিহ মুসলিম: ২৫৮৮)

৩. গুনাহ মাফ হয় ও আত্মা পরিশুদ্ধ হয়

  • যাকাত দিলে গুনাহ মাফ হয় এবং আত্মা শুদ্ধ হয়।
  • কুরআনে বলা হয়েছে: “তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যা দ্বারা আপনি তাদের পবিত্র করবেন এবং পরিশুদ্ধ করবেন।” (সূরা তাওবা: ১০৩)

৪. দারিদ্র্য দূর হয় ও সমাজে ভারসাম্য আসে

  • যাকাতের মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষরা উপকৃত হয়।
  • এটি দারিদ্র্য দূর করে এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করে।
  • রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যে জাতি তাদের গরিবদের প্রতি দয়া করে না, সে জাতি ধ্বংস হয়ে যায়।” (আবু দাউদ: ৪৮৪৩)

৫. মৃত্যুর পরও সওয়াব চলতে থাকে (সাদাকায়ে জারিয়া)

  • যদি যাকাত এমন কাজে ব্যয় করা হয় যা দীর্ঘস্থায়ী উপকার বয়ে আনে (যেমন—গরিব শিক্ষার্থীদের সহায়তা, চিকিৎসা, ইত্যাদি), তবে মৃত্যুর পরও সওয়াব চলতে থাকে।
  • রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যখন মানুষ মারা যায়, তখন তার আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে তিনটি আমল চলতে থাকে: সদাকায়ে জারিয়া, উপকারী জ্ঞান, এবং নেককার সন্তান।” (মুসলিম: ১৬৩১)

যাকাত দেওয়া শুধু একটি আর্থিক লেনদেন নয়, বরং এটি ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ যা মানুষের আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে, দারিদ্র্য দূর করে, সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে এবং জান্নাতের পথ সুগম করে। তাই প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমানের উচিত সময়মতো যাকাত আদায় করা।

যাকাত না দিলে কী সমস্যা হবে?

যাকাত আদায় করা ফরজ ইবাদত। কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে যাকাত না দেয়, তাহলে সে ইসলামের একটি মৌলিক বিধান লঙ্ঘন করবে এবং দুনিয়া ও আখিরাতে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে।

১. দুনিয়ার শাস্তি

  • সম্পদের বরকত চলে যাবে: যাকাত না দিলে সম্পদে বরকত নষ্ট হয়ে যায় এবং অর্থনৈতিক কষ্ট বাড়তে থাকে।
  • গরিব ও ধনীদের মধ্যে বৈষম্য বাড়বে: যাকাত সমাজে অর্থনৈতিক ভারসাম্য তৈরি করে। কিন্তু যদি ধনী ব্যক্তি যাকাত না দেয়, তাহলে ধনী-গরিবের পার্থক্য বেড়ে যায় এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়।
  • মহামারি ও দুর্যোগ আসতে পারে: রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে জাতি তাদের সম্পদের যাকাত প্রদান করে না, আল্লাহ তাদেরকে দুর্ভিক্ষ ও মহামারির মাধ্যমে শাস্তি দেন।” (তাবরানি, মুজামুল আওসাত: ১৮০১)

২. আখিরাতের শাস্তি

যাকাত না দিলে কিয়ামতের দিন কঠিন শাস্তির ঘোষণা রয়েছে।

  • অগ্নিতে দগ্ধ করা হবে: “যারা সোনা-রূপা পুঞ্জীভূত করে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, কিয়ামতের দিন তাদের এই সম্পদকে আগুনে গরম করে তাদের কপালে, পার্শ্বদেশে ও পিঠে চিহ্নিত করা হবে।” (সূরা আত-তাওবা: ৩৪-৩৫)
  • সাপের আকারে শাস্তি দেওয়া হবে: “যে ব্যক্তি তার সম্পদের যাকাত দেয় না, কিয়ামতের দিন সেই সম্পদ এক বিষধর সাপের রূপ নেবে। সাপটি তার গলায় পেঁচিয়ে তাকে দংশন করবে এবং বলবে: ‘আমি তোমার ধন-সম্পদ, আমি তোমার পুঞ্জীভূত সম্পদ!'” (বুখারি, হাদিস: ১৪০৩)

৩. ইসলামী শাস্তি (আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা)

ইসলামী রাষ্ট্রে যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে যাকাত না দেয়, তাহলে সরকার তার সম্পদ থেকে জোরপূর্বক যাকাত সংগ্রহ করতে পারে। এমনকি যুদ্ধ পর্যন্ত করার নির্দেশ রয়েছে—

“আমি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব যারা নামাজ পড়া এবং যাকাত দেওয়া থেকে বিরত থাকে।” (বুখারি, হাদিস: ১৩৯৯)

যাকাত না দেওয়া কেবল দুনিয়ার ক্ষতির কারণ নয়, বরং আখিরাতের ভয়াবহ শাস্তির কারণ। তাই প্রত্যেক মুসলমানের উচিত সময়মতো যাকাত প্রদান করা, যাতে সম্পদ পবিত্র হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়।

যাকাত কিভাবে দিলে বেশি সওয়াব হবে?

যাকাত দেওয়া শুধু একটি দায়িত্ব নয়, বরং এটি এমন একটি ইবাদত যা সঠিকভাবে আদায় করলে আল্লাহর কাছে অধিক সওয়াব পাওয়া যায়। কুরআন ও হাদিসে যাকাত দেওয়ার বিশেষ পদ্ধতি ও উত্তম উপায় সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নিচে যাকাত দেওয়ার কিছু করণীয় উল্লেখ করা হলো, যা অনুসরণ করলে বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে।

১. অন্তর থেকে খালেস নিয়ত করা

  • যাকাত দেওয়ার আগে অবশ্যই একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিয়ত করা উচিত।
  • রিয়া (লোক দেখানো) বা প্রশংসা পাওয়ার উদ্দেশ্যে দিলে সওয়াব পাওয়া যাবে না।
  • রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “নিশ্চয়ই আমলসমূহ নিয়তের ওপর নির্ভরশীল, আর মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিদান পাবে।” (সহিহ বোখারি: ১, মুসলিম: ১৯০৭)

২. গোপনে দান করা (যদি সম্ভব হয়)

  • গোপনে দান করা লোক দেখানোর প্রবণতা থেকে মুক্ত রাখে এবং বেশি সওয়াব পাওয়া যায়।
  • কুরআনে বলা হয়েছে: “যদি তোমরা প্রকাশ্যে দান করো, তবে তা উত্তম, আর যদি গোপনে দান করো এবং দরিদ্রদের দাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরও উত্তম।” (সূরা বাকারা: ২৭১)

৩. নিকট আত্মীয়দের মধ্যে যোগ্যদের অগ্রাধিকার দেওয়া

  • নিজের গরিব আত্মীয়দের যাকাত দিলে দ্বিগুণ সওয়াব হয়।
  • একদিকে যাকাতের সওয়াব পাওয়া যায়, অন্যদিকে আত্মীয়তার সম্পর্ক জোরদার হয়।
  • রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “একজন দরিদ্র আত্মীয়কে দান করা সাধারণ সদকার চেয়ে দ্বিগুণ সওয়াব এনে দেয়।” (তিরমিজি: ৬৫৮)

৪. সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় ব্যক্তিকে দেওয়া

  • এমন ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া উচিত, যার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আছে।
  • রাসুল (সা.) বলেছেন: “সবচেয়ে উত্তম দান হলো সেই ব্যক্তিকে দেওয়া, যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনمند।” (মুসলিম: ২৩৫৮)

৫. উত্তম সম্পদ থেকে যাকাত দেওয়া

  • সবচেয়ে ভালো ও হালাল উপার্জন থেকে যাকাত দেওয়া উচিত।
  • নিকৃষ্ট মানের বা অপ্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে যাকাত দিলে সওয়াব কমে যেতে পারে।
  • কুরআনে বলা হয়েছে: “হে ঈমানদারগণ! তোমরা যা কিছু উপার্জন করো এবং যা আমি ভূমি থেকে তোমাদের জন্য উৎপন্ন করি, তার উৎকৃষ্ট অংশ থেকে ব্যয় করো।” (সূরা বাকারা: ২৬৭)

৬. দানের সময় বিনয়ের সাথে দেওয়া

  • যাকাত গ্রহণকারীর সামনে অহংকার বা উপকার করার মনোভাব দেখানো উচিত নয়।
  • আল্লাহ বলেন: “তোমরা এমনভাবে দান করো না, যেন কারও ওপর তোমার কোনো অনুগ্রহ রয়েছে। এতে দানের সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়।” (সূরা বাকারা: ২৬৪)

৭. যাকাতের টাকা সঠিক খাতে ব্যয় করা

  • যাকাতের অর্থ শুধু ইসলামে নির্ধারিত আট শ্রেণির মানুষের কাছে পৌঁছানো উচিত (ফকির, মিসকিন, ঋণগ্রস্ত, আল্লাহর রাস্তায়, পথচারী ইত্যাদি)।
  • যদি সঠিক খাতে না দেওয়া হয়, তবে তা শুদ্ধ হবে না।
  • কুরআনে উল্লেখ আছে: “যাকাত তো কেবল ফকির, মিসকিন, যাকাতের কাজে নিয়োজিত, যাদের অন্তর ইসলামের দিকে আকৃষ্ট করা হয়, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্য নির্ধারিত।” (সূরা তাওবা: ৬০)

৮. প্রয়োজনে নিজ হাতে প্রদান করা

  • যদি সম্ভব হয়, তবে সরাসরি দান করা উত্তম। এতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে যাকাত সঠিক জায়গায় পৌঁছেছে।
  • তবে বর্তমানে বিশ্বস্ত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানেও যাকাত প্রদান করা যেতে পারে।

যাকাত শুধু সম্পদের একটি অংশ দান করা নয়, বরং এটি আত্মার পরিশুদ্ধি এবং দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম উপায়। সঠিকভাবে, খালেস নিয়তে এবং উপযুক্ত জায়গায় যাকাত প্রদান করলে সর্বোচ্চ সওয়াব পাওয়া যায় এবং আল্লাহর রহমত অর্জিত হয়।

যাকাত কোথায় দিলে গুনাহ হবে?

যাকাত এমন একটি ইবাদত যা সঠিক উপায়ে প্রদান না করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না এবং গুনাহের কারণ হতে পারে। ইসলামে নির্দিষ্ট শ্রেণির মানুষদের জন্য যাকাত নির্ধারিত আছে। যদি ভুল ব্যক্তিকে বা নিষিদ্ধ জায়গায় যাকাত দেওয়া হয়, তবে তা সহীহ হবে না এবং যাকাত আদায়ও হবে না।

১. যাকাত দেওয়ার নিষিদ্ধ স্থান ও ব্যক্তি:

১.১. ধনী ব্যক্তিকে যাকাত দেওয়া
  • কুরআন ও হাদিসে স্পষ্ট বলা হয়েছে যে, ধনী ব্যক্তি যাকাত গ্রহণ করতে পারবে না।
  • রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যার নেসাব পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, তার জন্য যাকাত গ্রহণ করা বৈধ নয়।” (তিরমিজি: ৬৫৩)
১.২. নিজের বাবা-মা ও পূর্বপুরুষদের দেওয়া
  • পিতা-মাতা, দাদা-দাদি, নানা-নানিকে যাকাত দেওয়া যাবে না, কারণ তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সন্তানদের ওপর ফরজ।
১.৩. নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের দেওয়া
  • একজন ব্যক্তি তার স্ত্রীকে যাকাত দিতে পারবে না, কারণ স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব স্বামীর ওপর।
  • নিজের সন্তানদেরও যাকাত দেওয়া যাবে না, কারণ সন্তানদের দায়িত্ব বাবার ওপর ফরজ।
১.৪. বংশধর রাসুল (সা.)-এর পরিবারকে দেওয়া
  • রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “নিশ্চয়ই এই যাকাত হলো মানুষের সম্পদের ময়লা, আর এটা মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিবার (আহলে বাইত)-এর জন্য বৈধ নয়।” (মুসলিম: ১০৭২)
১.৫. শর্তযুক্ত যাকাত প্রদান
  • যাকাত এমন কাউকে দেওয়া যাবে না যে প্রতিদানে কোনো কাজ করে দেবে বা বিনিময়ে কিছু দিতে হবে।
১.৬. মসজিদ, মাদরাসা বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেওয়া (সরাসরি নয়)
  • যাকাতের অর্থ মসজিদ বা মাদরাসার কোনো নির্মাণকাজে ব্যয় করা যাবে না, কারণ এটি কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিগত প্রয়োজন নয়। তবে গরিব শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগতভাবে দিলে যাকাত আদায় হবে।
১.৭. যাকাতের অর্থ অপচয় করা বা অনুপযুক্ত কাজে ব্যয় করা
  • যদি যাকাত এমন জায়গায় দেওয়া হয় যেখানে তা প্রকৃত গরিবদের কাজে না লাগে, তবে এটি গুনাহ হবে। যেমন—অপচয় করা, অপ্রয়োজনীয় কাজের জন্য ব্যয় করা, বা এমন কাউকে দেওয়া যে তা নষ্ট করে ফেলে।

২. যাকাত দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি:

যাকাত শুধুমাত্র আট শ্রেণির মানুষকে দেওয়া যাবে, যাদেরকে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে:

“যাকাত তো ফকির, মিসকিন, যাকাত আদায়কারীদের জন্য, যাদের মন আকৃষ্ট করতে হয়, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্য নির্ধারিত।” (সূরা আত-তাওবা: ৬০)

যাকাত সঠিক জায়গায় না দিলে তা আদায় হবে না এবং গুনাহ হবে। তাই নিশ্চিত হয়ে সঠিক ব্যক্তিকে যাকাত প্রদান করা উচিত।

যাকাত ও ফিতরার মধ্যে পার্থক্য: ইসলামিক দানের মূল ধারণা

যাকাত এবং ফিতরা ইসলামের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দান, তবে এগুলোর উদ্দেশ্য এবং সময় ভিন্ন।

  1. যাকাত:
    • অর্থ: যাকাত হলো একজন মুসলমানের ধন-সম্পত্তির নির্দিষ্ট অংশ গরিবদের সাহায্য করার জন্য দান করা।
    • পরিমাণ: সাধারণত প্রতি বছর সম্পদের 2.5% (১/৪০) যাকাত হিসেবে প্রদান করতে হয়।
    • সময়: যাকাত মাসিক বা বার্ষিক ভিত্তিতে দেওয়া যায়, তবে তা এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর দেওয়ার কথা।
    • উদ্দেশ্য: সম্পদ বিতরণের মাধ্যমে গরিবদের সাহায্য করা এবং দানশীলতা বৃদ্ধি করা।
  2. ফিতরা:
    • অর্থ: ফিতরা হলো ঈদুল ফিতরের দিন গরিবদের জন্য প্রদান করা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দান।
    • পরিমাণ: এটি সাধারণত একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য বা তার সমপরিমাণ অর্থ হতে পারে, যা প্রতিটি পরিবারের সদস্যের জন্য নির্ধারিত।
    • সময়: ঈদুল ফিতরের নামাজের পূর্বে ফিতরা প্রদান করা উচিত।
    • উদ্দেশ্য: গরিবদের ঈদের আনন্দ উপভোগে সহায়তা করা এবং ঈদের সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার জন্য প্রয়োজনীয় দান প্রদান করা।

সংক্ষেপে, যাকাত একটি বার্ষিক দান যা সম্পদের 2.5% থেকে নির্ধারিত হয়, যেখানে ফিতরা ঈদুল ফিতরের সময় গরিবদের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ দান যা প্রতিটি মুসলমানের জন্য বাধ্যতামূলক।

যাকাত ও ফিতরা এর সামঞ্জস্য বা মিলগুলো

যাকাত এবং ফিতরা ইসলামে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ দান, তবে তাদের উদ্দেশ্য, পরিমাণ, এবং সময় ভিন্ন হলেও কিছু সামঞ্জস্য বা মিল রয়েছে। নিচে তাদের মিলগুলো তুলে ধরা হলো:

১. দানের উদ্দেশ্য:

  • যাকাত এবং ফিতরা দুটোই গরিবদের সাহায্য করার উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নত করতে এবং সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করা হয়।
  • যাকাত দেওয়া হয় পুরো বছর জুড়ে সম্পদের উপর, যেখানে প্রতি বছর আপনার সঞ্চিত সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ গরিবদের দেওয়া হয়।
  • ফিতরা দেওয়া হয় ঈদুল ফিতরের সময়, গরিবদের ঈদের আনন্দের অংশীদার করার জন্য।

২. বাধ্যতামূলক:

  • যাকাত এবং ফিতরা দুটোই বাধ্যতামূলক দান। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে, যাদের যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে, তাদের জন্য উভয় দানই পালন করা বাধ্যতামূলক।
  • যাকাত: এটি তাদের জন্য বাধ্যতামূলক যারা নেসাব পরিমাণ সম্পদ মালিক (যেমন ৭৫ গ্রাম সোনা বা তার সমপরিমাণ সম্পদ)।
  • ফিতরা: ঈদুল ফিতরের সময় প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফিতরা দেওয়া বাধ্যতামূলক, যাদের কাছে ফিতরা দেওয়ার মতো সম্পদ রয়েছে।

৩. গরিবদের উপকার:

  • উভয় দানই গরিবদের উপকারে আসে। যাকাত গরিবদের মৌলিক চাহিদা পূরণে সহায়ক এবং ফিতরা গরিবদের ঈদ উৎসবের আনন্দে অংশগ্রহণ করতে সহায়ক। উভয় দানই সমাজে শান্তি, সমতা, এবং সহানুভূতির প্রতিষ্ঠা করে।

৪. দানের সঠিক সময়:

  • যাকাত: যাকাত প্রদান করা হয় প্রতি বছর, যখন এক বছর পূর্ণ হয় এবং সম্পদের উপর যাকাতের পরিমাণ নির্ধারিত হয়।
  • ফিতরা: ফিতরা ঈদুল ফিতরের দিন নামাজের আগে প্রদান করা হয়।

৫. সোশ্যাল ও কল্যাণমূলক উদ্দেশ্য:

  • উভয় দানই সমাজের কল্যাণে এবং ধনী ও গরিবের মধ্যে পার্থক্য কমানোর উদ্দেশ্যে প্রদান করা হয়।
  • যাকাত সম্পদের পুনঃবণ্টন ঘটানোর মাধ্যমে ধনীদের সম্পদের একটি অংশ গরিবদের কাছে পৌঁছায়।
  • ফিতরা ঈদুল ফিতরের সময় গরিবদের জন্য বিশেষ আনন্দ ও সাহায্য প্রদান করতে সাহায্য করে।

যাকাত এবং ফিতরা, যদিও সময়, পরিমাণ এবং উদ্দেশ্য ভিন্ন, তবে তাদের মূল লক্ষ্য হলো গরিবদের সাহায্য করা এবং সমাজে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। উভয় দানই মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে এক ধরনের সহানুভূতি এবং সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে সহায়ক।

ফিতরা কী?

ফিতরা হলো ঈদুল ফিতরের দিন গরিবদের সাহায্য করার জন্য মুসলমানদের দ্বারা দেওয়া একটি বিশেষ দান। এটি ঈদের আনন্দ সবাইকে সমভাবে উপভোগ করতে সাহায্য করে, বিশেষত গরিবদের জন্য।

ফিতরার মূল বৈশিষ্ট্য:

  • উদ্দেশ্য: গরিবদের সাহায্য করা এবং ঈদুল ফিতরের দিনে তাদেরকে আনন্দিত করা।
  • পরিমাণ: ফিতরার পরিমাণ সাধারণত এক ব্যক্তির জন্য খাদ্য বা তার সমপরিমাণ অর্থ। এটি সাধারণত ময়দা, খেজুর, কিসমিস, বা চাল হতে পারে, তবে সমপরিমাণ অর্থও দেওয়া যায়।
  • সময়: ঈদুল ফিতরের নামাজের আগে ফিতরা প্রদান করা উচিত।
  • বাধ্যতামূলক: প্রতিটি মুসলমানের ওপর ফিতরা প্রদান করা বাধ্যতামূলক, তবে এটি শিশুরাও অন্তর্ভুক্ত।

ফিতরা প্রদান করে একজন মুসলমান ঈদের দিন গরিবদের জন্য ঈদের আনন্দ সবার মধ্যে সমানভাবে বিতরণ করতে সহায়তা করে।

ফিতরা দিতে হবে? এটি কি বাধ্যতামূলক?

হ্যাঁ, ফিতরা দেওয়া বাধ্যতামূলক। ইসলামে ঈদুল ফিতরের দিন গরিবদের সাহায্য করার জন্য ফিতরা প্রদান করা সকল মুসলমানের উপর একটি কর্তব্য। এটি একজন মুসলমানের ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে গণ্য করা হয় এবং এটি ঈদের আনন্দ সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দিতে সাহায্য করে।

ফিতরা দেওয়ার বাধ্যতামূলকতা:

  • বয়স: ফিতরা দিতে হবে শিশু, বৃদ্ধ, পুরুষ বা মহিলা সকল মুসলমানকে, যদি তাদের কাছে ফিতরা দেওয়ার মতো পরিমাণ সম্পদ থাকে।
  • মালিকানা: যাদের কাছে ঈদের দিন ফিতরা দেওয়ার মতো সম্পদ বা আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে, তাদের উপর ফিতরা দেওয়া বাধ্যতামূলক।

ফিতরা দিয়ে, মুসলমানরা গরিবদের সাহায্য করতে পারে এবং তাদের ঈদের আনন্দে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।

ফিতরা যাকাত দিলে কী হয়?

ফিতরা এবং যাকাত দুটি আলাদা আলাদা দান, তবে এগুলোর উদ্দেশ্য এবং সময় ভিন্ন। যদি কেউ ফিতরা এবং যাকাত একসাথে প্রদান করেন, তবে তাদের দুইটি দানেরই আলাদা আলাদা সুবিধা ও প্রভাব থাকে।

ফিতরা এবং যাকাত দেওয়ার মধ্যে পার্থক্য:

  1. ফিতরা:
    • উদ্দেশ্য: ফিতরা দেওয়া হয় ঈদুল ফিতরের সময় গরিবদের সাহায্য করার জন্য, যাতে তারা ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে পারে।
    • সময়: ফিতরা ঈদুল ফিতরের নামাজের আগে প্রদান করা উচিত।
    • বাধ্যতামূলক: ফিতরা দেওয়া প্রতিটি মুসলমানের জন্য ঈদের একটি বাধ্যতামূলক দান।
  2. যাকাত:
    • উদ্দেশ্য: যাকাত হলো সম্পদের একটি অংশ গরিবদের সাহায্য করার জন্য প্রতিবছর প্রদান করা হয়।
    • সময়: যাকাত সাধারণত বছরে একবার, যাকাত দেওয়ার জন্য সম্পদের এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর প্রদান করতে হয়।
    • বাধ্যতামূলক: যাকাত দেওয়া তাদের জন্য বাধ্যতামূলক, যাদের সম্পদের পরিমাণ নেসাব (নির্ধারিত পরিমাণ) পৌঁছেছে।

ফিতরা এবং যাকাত একসাথে দিলে কী হয়?

  • অর্থনৈতিক সাহায্য বৃদ্ধি: ফিতরা এবং যাকাত একসাথে দিলে গরিবদের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্য বৃদ্ধি পায় এবং সমাজে দানশীলতার পরিবেশ তৈরি হয়।
  • ঈদের আনন্দ: ফিতরা ঈদুল ফিতরে গরিবদের আনন্দে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে, আর যাকাত গরিবদের দীর্ঘমেয়াদী সহায়তা প্রদান করে।
  • ধর্মীয় দায়িত্ব পূর্ণতা: ফিতরা এবং যাকাত দুটোই ইসলামিক দান, এবং একসাথে প্রদান করলে একটি মুসলমান তার ধর্মীয় কর্তব্য পূর্ণ করেন।

সুতরাং, ফিতরা এবং যাকাত একসাথে দিলে তা উভয় দানের উদ্দেশ্যই পূর্ণ হয় এবং গরিবদের সাহায্যের পাশাপাশি ধর্মীয় দায়িত্বও সম্পন্ন হয়।

ফিতরা কিভাবে দিলে বেশি সওয়াব হবে?

ফিতরা দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর নিকট সওয়াব অর্জন করতে হলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মনে রাখা উচিত। ফিতরা দেওয়া একটি ঈদুল ফিতরের গুরুত্বপূর্ণ আমল, এবং সঠিকভাবে এটি প্রদান করলে আল্লাহর কাছে বিশেষ সওয়াব পাওয়া যায়। সওয়াব বাড়ানোর জন্য নিচের কিছু পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে:

১. ঈদুল ফিতরের আগেই ফিতরা দেওয়া:

  • ফিতরা ঈদুল ফিতরের নামাজের আগে প্রদান করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু এটি একটি সময়সীমাবদ্ধ দান, সঠিক সময়ে দেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হয়।
  • যদি আপনি ঈদের দিন নামাজের আগে ফিতরা দেন, তা তখনই গ্রহণযোগ্য হবে এবং সওয়াব পাওয়া যাবে।

২. গরিবদের সাহায্য করার উদ্দেশ্য:

  • ফিতরা দেওয়ার মূল উদ্দেশ্য গরিবদের সাহায্য করা এবং তাদের ঈদের আনন্দের অংশীদার করা। সৎ উদ্দেশ্য এবং খালিস মনে ফিতরা প্রদান করলে সওয়াব বৃদ্ধি পায়।
  • যখন ফিতরা গরিবদের দেওয়া হয়, তাদের জন্য আনন্দ এবং প্রয়োজনীয়তা পূর্ণ হয়, এবং এটি আল্লাহর কাছে আরও মূল্যবান।

৩. নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি বা সংগঠনের মাধ্যমে দেওয়া:

  • ফিতরা দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তি বা সংস্থার মাধ্যমে দেওয়া উচিত, যারা সঠিকভাবে গরিবদের কাছে তা পৌঁছে দেয়। এতে আল্লাহর সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পাবে, কারণ এটি আপনার দানটি সঠিকভাবে ব্যবহৃত হবে।

৪. আল্লাহর প্রতি আন্তরিকতা:

  • ফিতরা দেওয়ার সময় আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্য থাকা উচিত, না যে কোনও গর্ব বা বাহবা পাওয়া। আপনি যদি তা খালিস মনে আল্লাহর জন্য করেন, তবে তা আরও বেশি সওয়াবের কারণ হবে।

৫. গোপনে ফিতরা দেওয়া:

  • ইসলামে গোপনে দান করা অধিক শ্রেয়, কারণ এতে রিয়া বা প্রদর্শন ছাড়া খালিস ইবাদত হয়। ফিতরা গোপনে দিলে সওয়াব বাড়ে এবং আল্লাহ তা আরও গ্রহণ করেন।

৬. একাধিক সদস্যের জন্য ফিতরা দেওয়া:

  • একটি পরিবার বা গৃহস্থের সদস্যদের জন্য ফিতরা দেওয়ার মাধ্যমে আপনি একাধিক গরিবকে সাহায্য করতে পারেন, এতে সওয়াবের পরিমাণ বাড়বে।

৭. সাধ্য অনুযায়ী বেশি পরিমাণে ফিতরা দেওয়া:

  • যাদের আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে, তারা একাধিক সদস্য বা গরিবদের জন্য বেশি পরিমাণে ফিতরা দিতে পারেন, যা তাদের সাহায্য করতে আরও কার্যকর হবে এবং সওয়াবও বাড়বে।

সুতরাং, ফিতরা দেওয়ার সঠিক সময়, উদ্দেশ্য, এবং পদ্ধতি অনুসরণ করলে তা অনেক বেশি সওয়াব অর্জন করতে সাহায্য করবে।

ফিতরা কোথায় দিলে গুনাহ হবে? বা দেয়া নিষিদ্ধ

ফিতরা দেওয়ার ক্ষেত্রে যদি কিছু ভুল পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, তবে তা গুনাহ হতে পারে বা ভুল জায়গায় দেওয়ার কারণে তা নিষিদ্ধ হতে পারে। তবে এটি একেবারে খোলামেলা ও স্পষ্ট বিষয়, এবং কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে যা মনে রাখা উচিত:

১. গরিবদের না দেওয়া:

  • ফিতরা দেওয়ার উদ্দেশ্য হলো গরিবদের সাহায্য করা, যাতে তারা ঈদের দিনে আনন্দ উপভোগ করতে পারে। যদি আপনি ফিতরা গরিবদের না দিয়ে অন্য কোথাও দেন, যেমন কারো ব্যক্তিগত লাভের জন্য বা এমন কোনো জায়গায় যেখানে গরিবরা উপকৃত হবে না, তাহলে তা গুনাহ হতে পারে
  • ফিতরা শুধুমাত্র গরিবদের প্রদান করতে হবে, যেমন: এতিম, ভিক্ষুক, বা অভাবী পরিবার।

২. খালিস উদ্দেশ্যে না দেওয়া:

  • ফিতরা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে প্রদান করা উচিত। যদি আপনার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র লোক দেখানো বা বিশ্বাসযোগ্যতার জন্য হয়, তবে তা অনুগ্রহের বদলে গুনাহ হতে পারে।
  • দানশীলতা এবং খালিস উদ্দেশ্য ছাড়া ফিতরা দিলে সওয়াব পাওয়া যাবে না, এবং গুনাহও হতে পারে।

৩. ফিতরা না দিয়ে তা অন্য জায়গায় খরচ করা:

  • যদি ফিতরা দেওয়া হয় এমন কোনো কাজের জন্য, যা ইসলামী দৃষ্টিকোণে অবৈধ বা নিষিদ্ধ (যেমন জুয়া, মাদক ইত্যাদি), তবে তা গুনাহ হবে এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জিত হবে না।

৪. ফিতরা সঠিক সময়ের পরে দেওয়া:

  • ফিতরা ঈদের নামাজের আগে দিতে হয়। যদি আপনি ঈদের নামাজের পরে ফিতরা দেন, তবে এটি সঠিকভাবে দেওয়া হবে না এবং সওয়াব পাওয়া যাবে না। কিন্তু এটি গুনাহ হবে না, তবে সময় মতো না দেওয়ার কারণে দানটি আদায় হবে না।

৫. ফিতরা কোনো একটি ফাউন্ডেশন বা সংগঠনের মাধ্যমে না দেওয়া:

  • যদি ফিতরা কোনও অবিশ্বস্ত বা অযোগ্য সংগঠন বা ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়, যাদের গরিবদের কাছে তা পৌঁছানোর নিশ্চয়তা নেই, তবে এটি যথাযথভাবে দেওয়া হবে না, এবং সওয়াব পাওয়া যাবে না। তবে এটি গুনাহ হবে না, কিন্তু এটি পরিহার করা উচিত।

ফিতরা দেওয়া গুনাহ হবে যদি তা সঠিকভাবে গরিবদের কাছে পৌঁছানো না হয়, বা তার উদ্দেশ্য খালিস না হয়। সুতরাং, ফিতরা গরিবদের জন্য এবং সঠিকভাবে দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে তা আপনার জন্য সওয়াব এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের কারণ হয়।

যাকাত ও ফিতরা আদায় প্রশ্ন উত্তর

যাকাত ও ফিতরা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দান, যা ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সম্পদ বণ্টনে সহায়তা করে। নিচে ২০২৫ সালের জন্য যাকাত ও ফিতরা আদায়ের সম্পর্কিত ২০টি প্রশ্ন ও তাদের উত্তর দেওয়া হলো:

  1. যাকাত কী? যাকাত হলো ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের একটি, যেখানে ধনী মুসলিমরা তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ গরীবদের দেন, যা সমাজে সমতা ও সহানুভূতি স্থাপন করে।
  2. ফিতরা কী? ফিতরা (ফিতরা দান) হলো রমজান মাস শেষে ঈদুল ফিতরের দিন গরীবদের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ দান, যা রোজার অভাব পূরণ করে এবং সমাজে আনন্দ ভাগাভাগি করে।
  3. যাকাত আদায়ের জন্য কিসের উপর দিতে হয়? যাকাত সাধারণত সোনা, রূপা, নগদ অর্থ, ব্যবসার মালামাল এবং কৃষিজাত পণ্যের উপর দিতে হয়।
  4. ফিতরা আদায়ের জন্য কিসের উপর দিতে হয়? ফিতরা সাধারণত খাদ্যদ্রব্যের উপর নির্ধারিত হয়, যেমন গম, খেজুর, কিসমিস বা যব।
  5. যাকাত দেওয়ার ন্যূনতম পরিমাণ কত? মালিকানাধীন সোনার পরিমাণ ৭.৫ তোলা বা রূপার ৫৭.৫ তোলা বা সমমূল্যের নগদ অর্থ বা মালামাল হলে, তার উপর ২.৫% যাকাত দিতে হয়।
  6. ফিতরা দেওয়ার পরিমাণ কত? প্রতি ব্যক্তি জন্য প্রায় ২ কেজি ৪০০ গ্রাম গম বা সমমূল্যের অর্থ ফিতরা হিসেবে নির্ধারিত হয়।
  7. যাকাত কখন দিতে হয়? যাকাত বছরের যে কোনো সময়ে দেওয়া যেতে পারে, তবে রমজান মাসের শেষ দশদিনে দেওয়া বিশেষভাবে মর্যাদাপূর্ণ।
  8. ফিতরা কখন দিতে হয়? ঈদুল ফিতরের নামাজের পূর্বে ফিতরা দেওয়া বাধ্যতামূলক।
  9. যাকাত ও ফিতরা আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য আছে কি? হ্যাঁ, যাকাত হলো নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের উপর ২.৫% দান, যা বছরে একবার দিতে হয়। ফিতরা হলো রমজান শেষে ঈদ উপলক্ষে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য বা অর্থ দান।
  10. যাকাত ও ফিতরা আদায় না করলে কী হয়? ইসলামে যাকাত ও ফিতরা আদায় না করা গুনাহ হিসেবে গণ্য হয় এবং সমাজে দরিদ্রদের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়।
  11. যাকাত ও ফিতরা আদায়ের জন্য কোনো নির্দিষ্ট আয় সীমা আছে কি? যাকাতের জন্য নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকা আবশ্যক, তবে ফিতরা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক, irrespective of income.
  12. ফিতরা আদায়ে কি কোনো নির্দিষ্ট বয়সসীমা আছে? ফিতরা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য বাধ্যতামূলক, বয়স নির্বিশেষে।
  13. যাকাত ও ফিতরা আদায়ের জন্য কি কোনো নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারিত আছে? না, তবে স্থানীয় দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা উত্তম।
  14. ফিতরা আদায়ের জন্য কি কোনো নির্দিষ্ট মুদ্রা ব্যবহার করতে হয়? না, তবে স্থানীয় মুদ্রায় সমমূল্যের খাদ্যদ্রব্য প্রদান করা যেতে পারে।
  15. যাকাত ও ফিতরা আদায়ের জন্য কি কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা আছে? যাকাত বছরের যে কোনো সময়ে দেওয়া যেতে পারে, তবে রমজান মাসে দেওয়া বিশেষভাবে মর্যাদাপূর্ণ। ফিতরা ঈদের নামাজের পূর্বে আদায় করতে হয়।
  16. ফিতরা আদায়ে কি কোনো নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে? ঈদের নামাজের পূর্বে মসজিদ বা স্থানীয় ইসলামী সংস্থার মাধ্যমে ফিতরা প্রদান করা যেতে পারে।
  17. যাকাত ও ফিতরা আদায়ের জন্য কি কোনো নির্দিষ্ট সংস্থা আছে? হ্যাঁ, বিভিন্ন ইসলামী সংস্থা ও মসজিদ ফিতরা ও যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণ করে থাকে।
  18. যাকাত ও ফিতরা আদায়ের জন্য কি কোনো নির্দিষ্ট নথিপত্র প্রয়োজন? না, তবে দানের পরিমাণ ও গ্রহণকারীর তথ্য রেকর্ড করা উত্তম।
  19. ফিতরা আদায়ে কি কোনো বিশেষ নিয়মাবলী আছে? ফিতরা প্রদানকারী ও গ্রহণকারীর মধ্যে কোনো বিরোধ না থাকলে, তা সরাসরি প্রদান করা যেতে পারে।
  20. যাকাত ও ফিতরা আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ দোয়া বা প্রার্থনা আছে কি? হ্যাঁ, দান করার পূর্বে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও গ্রহণযোগ্যতা কামনা করে দোয়া করা যেতে পারে।

এই প্রশ্ন ও উত্তরগুলো ২০২৫ সালের যাকাত ও ফিতরা আদায়ের বিষয়ে মৌলিক ধারণা প্রদান করে। স্থানীয় মসজিদ বা ইসলামী সংস্থার সাথে যোগাযোগ করে বিস্তারিত ও সর্বশেষ নির্দেশনা গ্রহণ করা উত্তম।

শেষ কথা

যাকাত ও ফিতরা ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুটি বিধান। যদি আমরা সবাই ঠিকমতো যাকাত ও ফিতরা আদায় করি, তাহলে সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য অনেকাংশে লাঘব হবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে যাকাত ও ফিতরা আদায়ের তৌফিক দান করুন।

1 thought on “যাকাত ও ফিতরা আদায় ২০২৫ সালের: অর্থ হিসাব ও পরিমাণ সম্পূর্ণ গাইড”

Leave a Comment