জিহাদ (جهاد) শব্দটি আরবি ভাষার একটি শব্দ। এটি “জাহাদা” (جَهَدَ) ধাতু থেকে উৎপন্ন, যার মূল অর্থ হলো পরিশ্রম করা, চেষ্টা করা, সংগ্রাম করা বা কঠোর প্রচেষ্টা করা। আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে, জিহাদ বলতে কোনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা বা সংগ্রামকে বোঝায়।
ইসলামী পরিভাষায়, জিহাদ বলতে আল্লাহর পথে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা বোঝানো হয়। এটি শুধু সশস্ত্র সংগ্রাম নয়, বরং ব্যক্তিগত, আধ্যাত্মিক, সামাজিক এবং সমাজকল্যাণমূলক কাজের বিস্তৃত ধারণাকে অন্তর্ভুক্ত করে। জিহাদের মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, নিজের আত্মশুদ্ধি এবং সমাজে শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা।
Also Read
- জিহাদ সম্পর্কে কোরআনের আয়াত: তাৎপর্য, ব্যাখ্যা ও শিক্ষা
- লাইলাতুল কদর – হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রাতের ফজিলত ও আমল
- যাকাত ও ফিতরা আদায় ২০২৫ সালের: অর্থ হিসাব ও পরিমাণ সম্পূর্ণ গাইড
- শুক্রবার ও ইসলামের গুরুত্ব: পবিত্র দিনের ফজিলত ও কোরআন-হাদিসের আলোকে
- জোলানির সিরিয়া পরিকল্পনা কী? • আন্তর্জাতিক সমালোচনা
জিহাদ শব্দটি কীভাবে হলো?
জিহাদ শব্দটির উৎপত্তি ও বিকাশ নিম্নরূপে বোঝা যায়:
- ভাষাগত উৎপত্তি:
- জিহাদ শব্দটি আরবি ধাতু “জাহাদা” (جَهَدَ) থেকে এসেছে। এই ধাতুর মূল অর্থ হলো কোনো কাজে শক্তি, সময় বা সম্পদ ব্যয় করে কঠোর পরিশ্রম করা।
- আরবি ভাষায় শব্দ গঠনের নিয়ম অনুসারে, “জাহাদা” থেকে “জিহাদ” শব্দটি গঠিত হয়, যা ক্রিয়ার বিশেষ্য রূপ (مَصْدَر)। এটি কোনো কাজে প্রচেষ্টা বা সংগ্রামের প্রক্রিয়াকে নির্দেশ করে।
- আরবি সাহিত্যে জিহাদ শব্দটি ইসলামের আগেও ব্যবহৃত হতো, তবে তখন এটি সাধারণভাবে যেকোনো কঠিন প্রচেষ্টা বা সংগ্রামের জন্য ব্যবহৃত হতো।
- ইসলামী প্রেক্ষাপটে জিহাদ:
- ইসলামের আগমনের পর জিহাদ শব্দটি একটি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক তাৎপর্য লাভ করে। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এই শব্দটি আল্লাহর পথে সংগ্রামের বিভিন্ন রূপ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে।
- কুরআনে জিহাদ শব্দটি ৪১ বার উল্লেখিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সূরা আল-হাজ্জের ৭৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
“এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করো যথাযথভাবে।”
এখানে জিহাদ বলতে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টাকে বোঝানো হয়েছে। - হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) জিহাদের বিভিন্ন রূপ ব্যাখ্যা করেছেন। একটি হাদিসে তিনি বলেছেন:
“সর্বোত্তম জিহাদ হলো নিজের নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।” (ইবনে হিব্বান)
3. ভুল ধারণা ও বিতর্ক:
- আধুনিক যুগে জিহাদ শব্দটি প্রায়ই ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হয় এবং এটিকে শুধু সশস্ত্র যুদ্ধ বা সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত করা হয়। এটি জিহাদের ব্যাপক ধারণার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
- ইসলামে সন্ত্রাসবাদ বা বেসামরিক মানুষের উপর হামলা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। জিহাদের লক্ষ্য হলো শান্তি, ন্যায় ও মানবকল্যাণ, যা শরিয়াহর নিয়ম মেনে করতে হয়।

জিহাদে কীভাবে অংশগ্রহণ করবেন • How To Join JIHAD | জিহাদ কী, জিহাদের উদ্দেশ্য, ইসলামী দৃষ্টিকোণ ও সঠিক পথ
জিহাদ শব্দটি প্রায়ই ভুলভাবে বোঝা হয় এবং এর সঠিক অর্থ ও প্রয়োগ নিয়ে অনেকের মনে বিভ্রান্তি রয়েছে। বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের মধ্যে জিহাদ সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভুল ব্যাখ্যা বা প্রচারণা তাদের বিপথে নিয়ে যেতে পারে। এই ব্লগ পোস্টে আমরা আলোচনা করব জিহাদ কী, জিহাদে কীভাবে অংশগ্রহণ করা যায়, এর উদ্দেশ্য কী এবং কীভাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটি প্রযোজ্য। আমাদের লক্ষ্য হলো শান্তিপূর্ণ ও শরিয়াহসম্মত উপায়ে জিহাদের ধারণা স্পষ্ট করা এবং সাধারণ প্রশ্নের উত্তর প্রদান করা।
জিহাদ কী?
জিহাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো পরিশ্রম, সংগ্রাম বা চেষ্টা। ইসলামী পরিভাষায় জিহাদ বলতে আল্লাহর পথে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টাকে বোঝায়। জিহাদ শুধু যুদ্ধ বা সশস্ত্র সংগ্রাম নয়, বরং এটি একটি ব্যাপক ধারণা যা ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির বিভিন্ন দিককে অন্তর্ভুক্ত করে।
জিহাদের প্রকারভেদ
জিহাদকে প্রধানত চারটি ভাগে ভাগ করা যায়:
- জিহাদ বিল নফস: নিজের কুপ্রবৃত্তি ও পাপের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিহাদ, যেখানে একজন মুসলিম নিজেকে পাপ থেকে দূরে রাখেন এবং সৎ জীবনযাপন করেন।
- জিহাদ বিল ইলম: জ্ঞান অর্জন ও প্রচারের মাধ্যমে ইসলামের সঠিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। এটি ভুল ধারণা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
- জিহাদ বিল মাল: সম্পদ দানের মাধ্যমে ইসলামের কল্যাণে অবদান রাখা, যেমন দান-সদকা বা সমাজসেবামূলক কাজ।
- জিহাদ বিল সাইফ: সশস্ত্র সংগ্রাম, যা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে এবং কঠোর শর্ত মেনে জায়েজ।
কুরআন ও হাদিসে জিহাদ
পবিত্র কুরআনে জিহাদ শব্দটি ৪১ বার উল্লেখিত হয়েছে, যা আল্লাহর পথে সংগ্রাম ও প্রচেষ্টার বিভিন্ন রূপ বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ, সূরা আত-তাওবার ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে:
“তোমরা আল্লাহর পথে জিহাদ করো তোমাদের সম্পদ ও জীবন দিয়ে।”
হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“সর্বোত্তম জিহাদ হলো নিজের নফসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।” (ইবনে হিব্বান)
জিহাদ বনাম সন্ত্রাসবাদ
জিহাদ কখনোই সন্ত্রাসবাদ নয়। ইসলামে বেসামরিক মানুষের উপর হামলা বা নির্বিচারে হত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। জিহাদের লক্ষ্য হলো শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা, যা শরিয়াহর নিয়ম মেনে করতে হয়।
জিহাদে অংশগ্রহণের উপায় – How To Join JIHAD
জিহাদে অংশগ্রহণের উপায় নির্ভর করে ব্যক্তির সামর্থ্য, পরিস্থিতি এবং ইসলামী শর্তের উপর। বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের জন্য শান্তিপূর্ণ জিহাদই সবচেয়ে প্রযোজ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ।
শান্তিপূর্ণ জিহাদে অংশগ্রহণ
- নিজের সংশোধন: নিয়মিত নামাজ, রোজা, কুরআন তিলাওয়াত ও সৎকাজের মাধ্যমে নিজের আত্মশুদ্ধি করা। পাপ ও খারাপ অভ্যাস থেকে দূরে থাকা।
- জ্ঞান অর্জন ও প্রচার: ইসলামের সঠিক শিক্ষা অর্জন করা এবং পরিবার, বন্ধু ও সমাজের মাঝে তা ছড়িয়ে দেওয়া। সামাজিক মাধ্যমে ইসলামের শান্তিপূর্ণ বার্তা প্রচার করা।
- দান-সদকা: দরিদ্রদের সাহায্য করা, মসজিদ বা মাদ্রাসায় দান করা, এবং সমাজসেবামূলক কাজে অংশ নেওয়া।
- সমাজসেবা: সমাজে শান্তি, ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করা, যেমন শিক্ষা প্রচার, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান বা পরিবেশ রক্ষা।
সশস্ত্র জিহাদে অংশগ্রহণ
সশস্ত্র জিহাদ শুধুমাত্র নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে জায়েজ, যেমন মুসলিমদের উপর অত্যাচার বা আগ্রাসনের সময়। এটি অবশ্যই বৈধ ইসলামী নেতৃত্বের অধীনে এবং শরিয়াহর কঠোর শর্ত মেনে হতে হবে। বাংলাদেশ দারুল আমান (শান্তির অঞ্চল) হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এখানে সশস্ত্র জিহাদ ফরজ নয়। তরুণ-তরুণীদের উচিত উগ্রবাদী বা ভুল প্রচারণা থেকে দূরে থাকা।
বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীদের জন্য
বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের জন্য জিহাদে অংশগ্রহণের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো শিক্ষা ও দাওয়াহ। ইসলামের সঠিক শিক্ষা অর্জন করে এবং তা অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে তারা সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। উগ্রবাদী বা ভুল পথে যাওয়ার পরিবর্তে শান্তিপূর্ণ ও সৃজনশীল কাজে মনোনিবেশ করুন।
জিহাদের উদ্দেশ্য
জিহাদের মূল উদ্দেশ্য হলো ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। এর মধ্যে রয়েছে:
- তাওহিদ প্রতিষ্ঠা: আল্লাহর একত্ববাদ প্রচার করা এবং শিরকের অবসান ঘটানো।
- অত্যাচার থেকে মুক্তি: মানুষকে অত্যাচার ও অন্যায় থেকে রক্ষা করা।
- শান্তি ও ন্যায়বিচার: সমাজে শান্তি, সাম্য ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা।
- মানবজাতির কল্যাণ: জিহাদের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উন্নতি সাধন।
অনেকে মনে করেন জিহাদ শুধুই যুদ্ধ, কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। জিহাদের মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা।
জিহাদে অংশগ্রহণের শর্ত
জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য কিছু ইসলামী শর্ত পালন করতে হয়, বিশেষ করে সশস্ত্র জিহাদের ক্ষেত্রে। এর মধ্যে রয়েছে:
- বৈধ নেতৃত্ব: জিহাদ অবশ্যই বৈধ ইমাম বা ইসলামী নেতৃত্বের অধীনে হতে হবে।
- স্পষ্ট উদ্দেশ্য: জিহাদের উদ্দেশ্য হতে হবে অত্যাচার প্রতিরোধ বা ইসলামের সুরক্ষা।
- শরিয়াহসম্মত পদ্ধতি: বেসামরিক মানুষের ক্ষতি করা বা নির্বিচারে হত্যা ইসলামে নিষিদ্ধ।
বাংলাদেশে সশস্ত্র জিহাদের কোনো শরিয়াহসম্মত ভিত্তি নেই। তাই তরুণ-তরুণীদের উচিত শান্তিপূর্ণ জিহাদে মনোযোগ দেওয়া, যেমন জ্ঞান প্রচার, সমাজসেবা এবং দাওয়াহ।
সাধারণ প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ১: জিহাদে অংশগ্রহণের জন্য কী কী প্রস্তুতি নিতে হবে?
উত্তর: ইসলামী জ্ঞান অর্জন, নৈতিক জীবনযাপন, এবং শান্তিপূর্ণ প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ। নিয়মিত নামাজ, কুরআন অধ্যয়ন এবং সৎকাজ এই প্রস্তুতির অংশ।
প্রশ্ন ২: বাংলাদেশে জিহাদে অংশ নেওয়ার উপায় কী?
উত্তর: জ্ঞান প্রচার, সমাজসেবা, দান-সদকা এবং ইসলামের শান্তিপূর্ণ বার্তা ছড়ানো। বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ জিহাদই প্রযোজ্য।
প্রশ্ন ৩: সশস্ত্র জিহাদ কখন জায়েজ?
উত্তর: শুধুমাত্র বৈধ নেতৃত্বের অধীনে, নির্দিষ্ট শর্তে এবং অত্যাচার প্রতিরোধের জন্য। বাংলাদেশে এটি ফরজ নয়।
প্রশ্ন ৪: জিহাদ কি সন্ত্রাসবাদের সমর্থন করে?
উত্তর: না, ইসলামে সন্ত্রাসবাদ নিষিদ্ধ। জিহাদ শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য শরিয়াহসম্মত প্রচেষ্টা।
প্রশ্ন ৫: তরুণ-তরুণীরা কীভাবে জিহাদে অবদান রাখতে পারে?
উত্তর: শিক্ষা, দাওয়াহ, সমাজসেবা এবং ইতিবাচক কাজের মাধ্যমে। উগ্রবাদ থেকে দূরে থেকে ইসলামের শান্তিপূর্ণ বার্তা ছড়ান।
বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীদের জন্য পরামর্শ
- জ্ঞান অর্জন: পবিত্র কুরআন, হাদিস এবং বিশ্বস্ত আলেমদের ব্যাখ্যা অধ্যয়ন করুন।
- সতর্কতা: উগ্রবাদী প্রচারণা বা ভুল ব্যাখ্যা থেকে সতর্ক থাকুন।
- শান্তিপূর্ণ অবদান: সমাজে শান্তি, ন্যায় ও ইসলামের সঠিক বার্তা ছড়ান।
- দাওয়াহ: ইসলামের শান্তিপূর্ণ শিক্ষা প্রচারে ভূমিকা রাখুন।
শেষ কথা
জিহাদ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা, যা শুধু যুদ্ধ নয়, বরং আত্মশুদ্ধি, জ্ঞান প্রচার এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। বাংলাদেশী তরুণ-তরুণীদের উচিত শান্তিপূর্ণ জিহাদে অংশ নেওয়া এবং ইসলামের সঠিক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া। কুরআন ও হাদিসের আলোকে জীবন পরিচালনা করে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনুন।
তথ্যসূত্র
- পবিত্র কুরআন
- সহিহ বুখারী ও মুসলিম
- বিশ্বস্ত ইসলামী ওয়েবসাইট (যেমন: hadithbd.com, quranerkotha.com)
- ইসলামী আলেমদের ব্যাখ্যা ও বই