লাইলাতুল কদর – হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রাতের ফজিলত ও আমল

লাইলাতুল কদর হলো ইসলামের অন্যতম পবিত্র রাত, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এই পোস্টে লাইলাতুল কদরের ফজিলত, গুরুত্ব, লক্ষণ, বিশেষ দোয়া ও করণীয় আমল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

লাইলাতুল কদর – হাজার মাসের চেয়ে উত্তম রাতের ফজিলত ও আমল

লাইলাতুল কদর হলো ইসলামের অন্যতম পবিত্র রাত, যা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে এবং যার গুরুত্ব অপরিসীম। এই রাতকে ‘হাজার মাসের চেয়ে উত্তম’ বলা হয়েছে, যা মুসলিমদের জন্য দোয়া, ইবাদত ও ক্ষমা লাভের শ্রেষ্ঠতম সুযোগ। কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন:

إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ
وَمَا أَدْرَاكَ مَا لَيْلَةُ الْقَدْرِ
لَيْلَةُ الْقَدْرِ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ
تَنَزَّلُ الْمَلَائِكَةُ وَالرُّوحُ فِيهَا بِإِذْنِ رَبِّهِمْ مِنْ كُلِّ أَمْرٍ
سَلَامٌ هِيَ حَتَّى مَطْلَعِ الْفَجْرِ

(সূরা আল-কদর, আয়াত ১-৫)

এই রাতে ফেরেশতারা নেমে আসেন এবং ভোর পর্যন্ত শান্তি ও রহমতের বার্তা নিয়ে আসেন।

লাইলাতুল কদরের ফজিলত

১. হাজার মাসের চেয়ে উত্তম:
লাইলাতুল কদরে করা ইবাদত ৮৩ বছরের ইবাদতের চেয়েও বেশি সওয়াব অর্জনের সুযোগ দেয়।

  1. ফেরেশতাদের আগমন:
    এই রাতে জিবরাইল (আ.)-সহ অসংখ্য ফেরেশতা দুনিয়াতে নেমে আসেন এবং মুমিনদের জন্য রহমত ও বরকত আনেন।
  2. গুনাহ মাফের সুবর্ণ সুযোগ:
    রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
    “যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমান ও ইখলাস সহকারে ইবাদত করবে, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (বুখারি, মুসলিম)

লাইলাতুল কদরের নির্দিষ্ট তারিখ

লাইলাতুল কদরের নির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কে নিশ্চিত কোনো তথ্য নেই, তবে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
“তোমরা রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করো।” (বুখারি)

এই হিসেবে সম্ভাব্য রাতগুলো হলো:

  • ২১ রমজান
  • ২৩ রমজান
  • ২৫ রমজান
  • ২৭ রমজান (সর্বাধিক সম্ভাব্য)
  • ২৯ রমজান

লাইলাতুল কদরের লক্ষণ

লাইলাতুল কদর চিহ্নিত করার জন্য কিছু লক্ষণ রয়েছে, যেমন:

✅ রাতটি খুবই শান্তিপূর্ণ হয়
✅ আবহাওয়া সুন্দর ও মনোরম থাকে
✅ অতিরিক্ত গরম বা ঠান্ডা অনুভূত হয় না
✅ সূর্যোদয়ের সময় সূর্যের আলো কিরণহীন হয়
✅ মনে প্রশান্তি অনুভূত হয়

লাইলাতুল কদরের বিশেষ আমল

এই রাতে বেশি বেশি ইবাদত করা উচিত। কিছু গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো:

কুরআন তিলাওয়াত: এই রাতে কুরআন পাঠ করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।

নফল নামাজ: লাইলাতুল কদরে তাহাজ্জুদ ও অন্যান্য নফল নামাজ আদায় করা উচিত।

তাসবিহ ও জিকির: ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আলহামদুলিল্লাহ’, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’ এবং ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ ইত্যাদি জিকির বেশি বেশি করা উচিত।

দোয়া ও ইস্তেগফার: আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া, জান্নাতের দোয়া করা ও দোযখ থেকে মুক্তির জন্য প্রার্থনা করা উচিত।

দান-সদকা: গরীব-দুঃখীদের সাহায্য করা এবং দান-খয়রাত করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ।

লাইলাতুল কদরের জন্য বিশেষ দোয়া

আম্মাজান আয়িশা (রা.) একবার রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করলেন,
“হে আল্লাহর রাসুল! যদি আমি জানতে পারি যে এটি লাইলাতুল কদর, তাহলে কী দোয়া করবো?”
রাসুল (সা.) উত্তর দিলেন, এই দোয়া পড়তে:

اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي

বাংলা অর্থ:
“হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করাকে ভালোবাসো, তাই আমাকে ক্ষমা করে দাও।” (তিরমিজি)

লাইলাতুল কদর কেন জরুরি?

লাইলাতুল কদর ইসলামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ রাত। এই রাতকে আল্লাহ তাআলা কুরআনে “হাজার মাসের চেয়ে উত্তম” বলেছেন, যা প্রায় ৮৩ বছরের ইবাদতের সমতুল্য। তাই একজন মুমিনের জীবনে এই রাতের গুরুত্ব অনেক বেশি। নিচে লাইলাতুল কদর কেন জরুরি তা তুলে ধরা হলো:

১. এটি হাজার মাসের চেয়ে উত্তম

কুরআনে বলা হয়েছে,

“লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে উত্তম” (সূরা আল-কদর: ৩)

হাজার মাস অর্থাৎ প্রায় ৮৩ বছরের ইবাদতের চেয়ে এক রাতের ইবাদতের মূল্য বেশি। একজন মানুষ সাধারণত এত দীর্ঘ জীবন পান না, তাই এই রাতের ইবাদতের মাধ্যমে তিনি অনেক বড় সওয়াব অর্জন করতে পারেন।

২. এই রাতে কুরআন নাজিল হয়েছে

লাইলাতুল কদর এত গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এই রাতে আল-কুরআন নাজিল হয়েছে। এটি ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, যা সমগ্র মানবজাতির পথনির্দেশক।

৩. গুনাহ মাফ পাওয়ার শ্রেষ্ঠ সুযোগ

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

“যে ব্যক্তি ঈমান ও ইখলাসের সাথে লাইলাতুল কদরে ইবাদত করবে, তার অতীতের সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে।” (বুখারি, মুসলিম)

এই রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের গুনাহ মাফ করে দেন, যা একজন মুমিনের জন্য পরকালীন মুক্তির এক বিশাল সুযোগ।

৪. ফেরেশতাদের আগমন ও রহমত বর্ষণ

এই রাতে অসংখ্য ফেরেশতা দুনিয়ায় নেমে আসেন এবং তারা মুমিনদের জন্য রহমত ও কল্যাণ কামনা করেন।

“এই রাতে ফেরেশতারা ও জিবরাইল (আ.) তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেক কাজে অবতীর্ণ হন।” (সূরা আল-কদর: ৪)

৫. এই রাত শান্তি ও কল্যাণময়

কুরআনে বলা হয়েছে,

“এই রাত ফজর পর্যন্ত শান্তি ও নিরাপত্তার রাত।” (সূরা আল-কদর: ৫)

এই রাতে আল্লাহ তাআলা মানুষের জন্য রহমত বর্ষণ করেন, যা আমাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তির এক বিশাল সুযোগ।

৬. জান্নাত লাভের সুযোগ

এই রাতে সঠিকভাবে ইবাদত করলে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়, যা জান্নাতের অন্যতম পথ। আমাদের দুনিয়ার জীবন অনেক ছোট, কিন্তু এই রাতের ইবাদত আমাদের চিরস্থায়ী জীবনের জন্য জান্নাতের দুয়ার খুলে দিতে পারে।

লাইলাতুল কদর কবে ও কেন শুরু হয়েছে?

লাইলাতুল কদর একটি বিশেষ রাত, যা ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কুরআনে “হাজার মাসের চেয়ে উত্তম” (সূরা আল-কদর: ৩) বলে বর্ণিত হয়েছে। তবে এই রাতের নির্দিষ্ট তারিখ সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য নেই। ইসলামের ইতিহাস ও কুরআন-হাদিসের আলোকে লাইলাতুল কদর কবে এবং কেন শুরু হয়েছে তা ব্যাখ্যা করা হলো।

◼️ লাইলাতুল কদর কবে?

লাইলাতুল কদরের নির্দিষ্ট দিন সম্পর্কে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) সুস্পষ্টভাবে কিছু জানাননি, তবে বিভিন্ন হাদিসে বলা হয়েছে যে, এটি রমজান মাসের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোর মধ্যে একটি

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“তোমরা লাইলাতুল কদরকে রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে অনুসন্ধান করো।” (বুখারি, মুসলিম)

সাধারণভাবে ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ রমজান লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে অনেক ইসলামিক পণ্ডিত ২৭ রমজানকেই সবচেয়ে সম্ভাব্য বলে মনে করেন।

হযরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বলেন:
“আল্লাহর শপথ! আমি জানি যে, এটি ২৭ রমজানের রাত।” (মুসলিম)

◼️ লাইলাতুল কদর কেন শুরু হয়েছে?

লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও সূচনা সম্পর্কে জানা যায় প্রধানত দুটি কারণে:

১. এই রাতে কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে

লাইলাতুল কদরের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এই রাতে আল-কুরআন নাজিল হওয়া

আল্লাহ তাআলা বলেন:
“নিশ্চয়ই আমি এটি (কুরআন) লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ করেছি।” (সূরা আল-কদর: ১)

এর অর্থ হলো, কুরআনের প্রথম ওহি বা ধারাবাহিক নাজিলের সূচনা হয় এই রাতে।

২. মুসলিমদের জন্য বিশেষ রহমত ও বরকতের রাত

মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য এই রাতকে গুনাহ মাফের সুযোগ, দোয়া কবুলের রাত এবং রহমত ও শান্তির রাত হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।

একটি হাদিসে এসেছে,
“যে ব্যক্তি ঈমান ও ইখলাসের সঙ্গে লাইলাতুল কদরে ইবাদত করবে, তার পূর্বের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হবে।” (বুখারি, মুসলিম)

এই কারণেই এই রাতটি মুসলিমদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

লাইলাতুল কদর এমন একটি রাত, যা আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে উপহার দিয়েছেন। এটি নির্দিষ্টভাবে কবে হয় তা গোপন রাখা হয়েছে, যাতে মানুষ পুরো রমজানের শেষ দশক ইবাদতে কাটায়। এই রাতের মূল কারণ হলো কুরআনের নাজিল হওয়া, ফেরেশতাদের অবতরণ ও গুনাহ মাফের সুযোগ

তাই আমাদের উচিত রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি রাত ইবাদত, দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনায় কাটানো, যেন আমরা এই বরকতময় রাতের পূর্ণ ফজিলত অর্জন করতে পারি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে লাইলাতুল কদরের বরকত লাভের তৌফিক দান করুন। আমিন।

লাইলাতুল কদর রাতের নামাজ কিভাবে পড়তে হয়?

লাইলাতুল কদর হলো এক বিশেষ রাত, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। এই রাতে বেশি বেশি ইবাদত করা উচিত, বিশেষ করে নফল নামাজ পড়ার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা।

লাইলাতুল কদর রাতের নামাজ পড়ার নিয়ম

১. তাহাজ্জুদ নামাজ:

  • রাতের সেরা নামাজ তাহাজ্জুদ
  • কমপক্ষে ২ রাকাত থেকে ৮ বা ১২ রাকাত পর্যন্ত পড়া উত্তম।
  • প্রত্যেক ২ রাকাত পর সালাম ফিরিয়ে নেওয়া ভালো।

২. বিশেষ নফল নামাজ:

  • অনেক ইসলামি পণ্ডিত বলেন, ১২ রাকাত নফল নামাজ পড়া উত্তম।
  • প্রতিটি ২ রাকাতে সালাম ফিরিয়ে পড়তে হয়।
  • প্রথম রাকাতে সুরা ফাতিহার পর যেকোনো সুরা,
  • দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ফাতিহার পর অন্য কোনো সুরা পড়তে হয়।

৩. শবে কদরের বিশেষ নামাজ (৪ রাকাত):
একটি হাদিসে বর্ণিত আছে,
👉 ৪ রাকাত নামাজ পড়লে আল্লাহ তাআলা ৭০ হাজার ফেরেশতা পাঠিয়ে তার জন্য দোয়া করান।

পড়ার নিয়ম:

  • প্রথম রাকাতে: সুরা ফাতিহা + সুরা কদর (৩ বার)
  • দ্বিতীয় রাকাতে: সুরা ফাতিহা + সুরা ইখলাস (৩ বার)
  • তৃতীয় ও চতুর্থ রাকাত একইভাবে পড়তে হয়।

৪. সালাতুত তাসবিহ:

  • এটি একটি বিশেষ নামাজ, যা ৪ রাকাত পড়তে হয়।
  • এতে প্রতি রাকাতে ৭৫ বার “সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার” পড়তে হয়।

৫. ইস্তিগফার ও দোয়া:

  • নবী (সা.) বলেছেন, এই রাতে বেশি বেশি “আস্তাগফিরুল্লাহ” পড়তে হবে।
  • হাদিসে এসেছে,
    “اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّي”
    (উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফা’ফু আন্নি)
    অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি ক্ষমাশীল, ক্ষমা করতে ভালোবাসো, তাই আমাকে ক্ষমা করে দাও। (তিরমিজি)

৬. কুরআন তিলাওয়াত ও জিকির:

  • কুরআন তিলাওয়াত করুন
  • তাসবিহ-তাহলিল ও দরুদ শরিফ বেশি বেশি পড়ুন

শেষ কথা

লাইলাতুল কদর আমাদের জন্য এক বিশেষ নেয়ামত। এই রাতের ইবাদত আমাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। তাই আমাদের উচিত রমজানের শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোতে ইবাদতে মশগুল থাকা, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং দোয়া করা যেন আমরা জান্নাত লাভ করতে পারি।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে লাইলাতুল কদরের ফজিলত অর্জন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

Leave a Comment

Advertisement